
মোঃতানজিলুল ইসলাম লাইক,
রাজশাহী জেলা প্রতিনিধি :
রাজশাহী মেডিকেল কলেজ হাসপাতাল, উত্তরবঙ্গের চিকিৎসা ক্ষেত্রে অন্যতম প্রধান কেন্দ্র, বর্তমানে মারাত্মক সংকটের মুখে। সরকারি তথ্য অনুযায়ী, হাসপাতালের ৬০টি ওয়ার্ডের মধ্যে ২১টিতে শূন্য রয়েছে বিভাগীয় প্রধান বা অধ্যাপক চিকিৎসক।
এতে রোগীদের চিকিৎসা সেবা ও ইন্টার্ন চিকিৎসকদের প্রশিক্ষণে মারাত্মক ব্যাঘাত ঘটছে। আগামী ১৫ সেপ্টেম্বর রেডিও থেরাপী ও ৩০ ডিসেম্বর রেডিওলজি অ্যান্ড ইমেজিং বিভাগের অধ্যাপকও অবসরে যাবেন, ফলে শূন্য পদ আরও দুইটি বেড়ে ২৩ হবে।
হাসপাতালের পরিচালক ব্রিগেডিয়ার জেনারেল এফএম শামীম আহমেদ জানিয়েছেন, এ পদগুলো পূরণের জন্য স্বাস্থ্য মন্ত্রণালয়ের সিনিয়র সচিবকে গত ১৫ মে চিঠি দেওয়া হয়েছে, কিন্তু এখনো কোনো কার্যকর পদক্ষেপ হয়নি।
অধ্যাপক শূন্য থাকার কারণে ওয়ার্ডগুলোতে রোগীর সেবা, ইন্টার্নদের প্রশিক্ষণ এবং এফসিপিএস কোর্স সম্পন্ন করা মারাত্মকভাবে ব্যাহত হচ্ছে। প্রতি মাসে প্রায় ৩০০ জন চিকিৎসক এখানে ইন্টার্ন ও মিডলেভেল চিকিৎসকদের জন্য প্রশিক্ষণ নেন। শূন্য পদগুলোর কারণে প্রশিক্ষণও বাধাগ্রস্ত হচ্ছে।
বর্তমানে হাসপাতালে প্রতিদিন গড়ে ৫ হাজার রোগী বর্হিবিভাগে চিকিৎসা পান এবং তিন হাজার রোগী ভর্তি থাকেন। অথচ কাগজে-কলমের শয্যা সংখ্যা ১২শ, বাস্তবে জনবল রয়েছে মাত্র ৫০০ শয্যা। এর ফলে রোগী ফ্লোর, বারান্দা ও খোলা জায়গায় শুয়ে থাকতে বাধ্য হচ্ছেন। বিশেষ করে ডেঙ্গু আক্রান্ত রোগীর সংখ্যা বেড়ে যাওয়ায় সমস্যা আরও তীব্র।
হাসপাতালের সূত্রে জানা যায়, সার্জারি, ইউরোলজি, বার্ন ও প্লাস্টিক সার্জারি, নিউরো সার্জারি, শিশু সার্জারি, ক্লিনিক্যাল নিউরো সার্জারি, অর্থোপেডিক সার্জারি, চক্ষু, নাক-কান-গলা ও নেক সার্জারি, রিউমোটলজি, হেমাটলজি, হেপাটলজি, গ্যাস্ট্রোএন্টারোলজি, নিউরো মেডিসিন, ফিজিক্যাল মেডিসিন, মানসিক ব্যাধি, ডার্মাটলজি, নিওনেটলজি, পেডিয়াট্রিক হেমাটলজি ও অনকোলজি এবং রিমোভেবল অর্থোপেডিক বিভাগের শূন্য অধ্যাপক পদ দীর্ঘদিন ধরে অব্যাহত।
রোগীদের স্বজনরা অভিযোগ করছেন, হাসপাতালের অভিজ্ঞ চিকিৎসকের অভাবে চিকিৎসা ঠিকমতো হচ্ছে না। নিউরো মেডিসিন বিভাগের রোগীর স্বজন আসগর আলী বলেন, ‘বড় স্যাররা তো দিনে একমাত্র একবার আসেন।
রোগীর চিকিৎসা ঠিকমতো হয় না। যা করেন ইন্টার্ন চিকিৎসকরা করেন।’ আর নিইরো সার্জারি বিভাগের রোগীর স্বজন আলতাফ হোসেন বলেন, ‘আমার রোগীর অপারেশন হবে বলে বলা হয়েছিল, কিন্তু হয়নি। এখন বলছেন সামনে সপ্তাহে করাবেন। সিরিয়াল পাইনি আমার রোগী।’
এ ছাড়া বেসরকারি হাসপাতাল ও পরীক্ষা-নিরীক্ষার প্রতিষ্ঠানগুলোতে আধুনিক যন্ত্রপাতি নেই। অনেক প্রতিষ্ঠান ১০–২০ বছর পুরনো মেশিন ব্যবহার করছে। হাসপাতালের বাইরে দালাল সিন্ডিকেটের কারণে রোগীর অর্থ ও সময় নষ্ট হচ্ছে। হাসপাতালের ফার্মেসি ও ক্লিনিকে রোগীরা প্রতারণার শিকার হচ্ছেন।
উদাহরণস্বরূপ, রাজশাহী লক্ষীপুর মোড়ের মহারাজ ফার্মেসি, আলিফ লাম মিম ফার্মেসি ও আরোগ্য নিকেতন দীর্ঘদিন ধরে এ ধরনের প্রতারণা চালাচ্ছে। টেস্টের জন্য রোগীদের ভুয়া রিপোর্টে অর্থ হাতানো এবং ডাক্তারদের বেশি কমিশন পাওয়ার জন্য রোগীকে পাঠানোও সাধারণ অভিযোগ।
পরিচালক ব্রিগেডিয়ার জেনারেল এফএম শামীম আহমেদ বলেন, ‘অধ্যাপকগণ অভিজ্ঞ এবং তাদের জ্ঞানের ভাণ্ডার জুনিয়র বা মিডলেভেল চিকিৎসকদের চেয়ে অনেক বেশি।
মুমূর্ষু রোগীদের সেবার ক্ষেত্রে তাদের সিদ্ধান্ত অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ। শূন্য পদ থাকলে উন্নতমানের চিকিৎসা দেওয়া সম্ভব নয়, এটাই বাস্তবতা। আমরা সর্বাত্মক চেষ্টা চালাচ্ছি, তবে মন্ত্রণালয়ের সক্রিয় পদক্ষেপ অপরিহার্য।’
রাজশাহীর স্বাস্থ্যসেবা এখন মারাত্মক সংকটের মুখোমুখি। রোগী ও জনসাধারণের আস্থা হ্রাস পাচ্ছে। অনেকেই দেশের বাইরে, বিশেষ করে ভারতে চিকিৎসা করার দিকে ঝুঁকছেন। এতে দেশের কোটি কোটি টাকা বিদেশে চলে যাচ্ছে।
হাসপাতাল ও সংশ্লিষ্ট কর্তৃপক্ষের প্রতি দ্রুত পদক্ষেপ গ্রহণ না করা হলে সংকট আরও তীব্র হবে। নাগরিকের স্বাস্থ্য ও আস্থা পুনঃস্থাপনের জন্য প্রয়োজন শূন্য পদ পূরণ, আধুনিক যন্ত্রপাতি যোগ, দুর্নীতি ও প্রতারণা বন্ধ করা এবং ইন্টার্ন-চিকিৎসক প্রশিক্ষণ নিশ্চিত করা।